অসম প্রেম ও একটি চিঠি

'আজকে আর অফিসে না গেলাম' কথাটা বলতে বলতে সদ্য বেছানো বিছানার উপরে গা এলিয়ে দিলো নিশি। 
-তাহলে আমিও আজ ভার্সিটি না যাই?
-না গেলে নাই। কিন্তু ওঠো তো ওঠো গা ছেড়ে দিবে না একদম। ভাত বসাবো একটু পরে, সাথে বেগুনটা একটু কেটে দিবা। ভাজবো।
-আচ্ছা, তা বেশ। তবে তুমি তো আর এক্ষণি উঠছো না।
সাফাতের কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে নিশি আর কিছু বললো না। পাশে গা এলিয়ে নিশির গালে চুম্মন আঁকলো সাফাত। তারপর গা জড়িয়ে শুয়ে থাকলো বেশ কতোক্ষণ। 

-ওমা... ওঠো। কয়টা বাজে খেয়াল আছে?
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো নিশি।
সাফাত হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিষম খেলো। পাক্কা ১২টা বেজে গেলো। এখনো নাস্তা করা হয়নি।
-এতো অনিয়ম করলে চলে? (নিশি)
-অনিয়ম কি আমি একাই করি হুহ (সাফাত)
-আচ্ছা হয়েছে ওঠো।
সাফাত বাথরুমে ফ্রেশ হয়েছে। নিশি চটপট কিছু একটা বানিয়ে ফেলে। টুনাটুনির সংসার, একটুতেই সন্তুষ্ট, ভালোই চলছে।

"নিশি"। নিশি মেয়েটা দারুন কর্মঠ৷ ঢাকা ভার্সিটির সিএসসি হতে বি.এস.সি করে এই বছরই বেরিয়েছে। বাস্তবতার তাগিদে অতি দ্রুতই তাকে চাকরির ব্যবস্থা করতে হয়েছে। সাফাত একই ডিপার্টমেন্টে তারই এক ব্যাচ জুনিয়র। দুজনের পরিচয়টাও হয়েছে আরও আকস্মিকভাবে। 

ক্যাম্পাসের প্রথম দিনেই র্যাগিংয়ের স্বীকার হয় সাফাত। এক বড় ভাইয়ের নির্দেশ মোতাবেক প্রেম নিবেদন করতে হবে নিশিকে। যেই কথা সেই কাজ। রিমি দেখতে অতোটা সুন্দর না হলেও ১ম বর্ষ হতেই ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অথবা গঠনমূলক যে কোন প্রোগ্রামে তার উপস্থিতি লক্ষণীয়। আত্মসম্নান আর ভাবগাম্ভীর্যের জোরে সে এখনও পর্যন্ত কারও প্রেম নিবেদন গ্রহণ করেনি। সাফাতকে প্রথম দেখায় নিশির ভালো লাগে। প্রথমে হুমকি ধামকি দেখালেও পরে স্বাভাবিক আচরণ, দিনে দিনে কথাবার্তা বাড়তে থাকে, ধীরে ধীরে কখন যে সাপাত তার স্বত্তায় মিশে যায় নিশি তা ভাবতেও পারে না। শেষ পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক পরিণতিও পায়। সে বহু দীর্ঘ আলাপন। বিয়ের মাস খানেক পর তারা নতুন বাড়িতে শিফট হয়। নিশির অফিস আর সাফাতের ভার্সিটি মেইনটেইন করতে বাসাটা বদলাতেই হতো। উপরের আলাপন ছিল মূলত  সদ্য সদ্য ঘর গুছানোর পরপরই।

মাঝে কেটে গেছে পঁচিশটা বছর। নিশি এখন মিস নিশি মনসুর; ডিপার্টমেন্টাল হেড, সি.এস.সি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। তার শ্যাম বর্ণের মুখটি এখন সর্বদা হাসোজ্জল। একমাত্র ছেলে সাদ-কে নিয়ে ভালোই দিন কাটছে তার। বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ তার শিক্ষকজীবনের ১৫তম ব্যাচের বিদায় অনুষ্ঠান। ছেলে সাদও এই ব্যাচেরই শিক্ষার্থী।একে একে ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক ও বিদায়ী শিক্ষার্থীরা সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর ডাক আসে মিস নিশি মনসুরের। সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর নিশি মনসুরের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী 'মাঈসা' তাঁকে তার সফল জীবনের একটি খন্ড চিত্র তুলে ধরতে অনুরোধ করেন। অন্য কেও হলে হয়তো এড়িয়ে যেতেন, তবে মাঈসার অনুরোধ তিনি ফেলতে পারলেন না।

মিস নিশি মনসুর শুরু করলেন,
" বাবা মায়ের দুই সন্তানের মধ্যে আমি ছিলাম বাড়ির একমাত্র ও ছোট মেয়ে। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। এলাকায় সম্ভ্রান্ত পরিবার আমাদের। "
(হলরুমে পিনপতন নিরবতা।  সবাই অত্যন্ত মনোযোগী হয়েই শুনছে।)
পরিবারের সবচেয়ে আদুরে সদস্য ছিলাম বলাই চলে। তবে আমার বড় ভাই কিন্তু আমার প্রতি ছিলেন ভীষণ স্ট্রিক্ট। স্কুল হতে কলেজ সব জায়গায়ই ছিলো তার নজরদারী। আমাদের সময় প্রাইমারীতে বৃত্তি পরীক্ষা হতো। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে ছিলাম।  আমার এখনও মনে আছে বাবা আশেপাশের তিন গ্রাম মিষ্টি বিলিয়েছিলেন। এরপর মেট্রিক, জেলায় তৃতীয় হয়েছিলাম। বহু জুড়াজুড়ির পর বাবা   বড় মামা, ভাই আর আমাকে সাজেক ঘুরতে পাঠিয়েছিলেন। সেবার ঘুরতে গিয়ে  আমার ঠান্ডা লেগে যাওয়ায় বাবা মা আর মামাকে কি পরিমাণ বকলেন, তা কি আর ভোলা যায়?
-তাহলে বাল্যকাল ভালোই কেটেছে ম্যামের? (উৎসুক শিক্ষার্থীগণ)

-তাতো বটেই। মেট্রিকের পর জেলা কলেজে ভর্তি হলাম। ইন্টারে আশানুরূপ ফল হয়নি। তবে খোদা হয়তো একদিকে খুঁত রাখলে অন্যদিকে পুষিয়ে দেয়। চান্স পেলাম স্বপ্নের জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দিনকাল ভালোই চলছিল। বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠান আয়োজনে অংশগ্রহণ করতাম; কখনো সংকোচ বোধ করিনি।
 ফার্স্ট ইয়ার হতে তখন কেবল সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। একদিন চারুকলার সামনে দাড়িয়ে। কাঁপা কাঁপা হাতে গোলাপ নিয়ে এক ছেলে এগিয়ে এলো। 
-সাদের বাবা? (মাঈসা)
(মিস নিশি এড়িয়ে গেলেন)

আগেও এরকম বহুজন এসেছে। দেখেই বুঝতে পারলাম ছেলেটা র্যাগিংয়ের স্বীকার। প্রথমে বকা জোকা করলাম। জিঞ্জাস করতে জানলাম একই ডিপার্টমেন্টের। ছেলেটা তখনই না গিয়ে ভ্যাবলার মতো দাড়িয়ে ছিলো। তার তাকানো দেখে মায়া হচ্ছিল।
এরপরের কয়েক সপ্তাহ ছেলেটাকে প্রায়ই আশে পাশে দেখতে পাচ্ছিলাম। প্রথমে ভাবছিলাম একই ডিপার্টমেন্ট বলে হয়তো,  পরে লক্ষ্য করলাম ব্যাপারটা একটু বেশিই ঘটছে।
(মিস নিশি কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে বহু বছরের চাপা অভিমান অনুরাগ আর অবর্ণীত স্মৃতি তিনি প্রকাশ করছেন। শিক্ষার্থীদের বিদায়ী বক্তব্য রাখছেন এ চিন্তা এখন তার মাঝে নেই)

একদিন সাহস করে করে ডাক দিলাম ছেলেটাকে। সে নানাভাবে আমার ভুল হচ্ছে বুঝোতে চাইলেও আমি তাকে সেদিন সবার সামনে অপমান করেছিলাম। যদিও এতোটা করার ইচ্ছে ছিলো না।
তার পরে ৩মাস ছেলেটাকে দেখিনি। কেমন জানি একটা মায়া জন্মে গেলো ছেলেটার প্রতি। হয়তো সেদিন সবার সামনে ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। তারপর থেকে ছেলেটার খোঁজ-খবর নিতো শুরু করলাম। ছেলেটা ভালো গান করতো। বেশ কয়েকবার লুকিয়ে শুনিছে সেই মায়াভরা কণ্ঠ। একদিন আড়াল থেকে গান শুনতে শুনতে খেয়ালই করিনি কখন ছেলেটা চোখ ফাঁকি দিয়ে একদম কাছে চলে আসে। 

-এখানে বসেই শুনতে পারেন, সমস্যা নেই (সাফাত)
-না মানে ইয়ে..
ততক্ষণে মুখ লাল করে কথা না বাড়িয়ে বসে পড়লাম। আজ এই প্রথম ছেলেটাকে এতো কাছ থেকে দেখছি। চিকন ফ্রেমের চশমা, চুল লম্বা হলেও পরিপাটি। অনেকটা ক্ল্যাসিকাল ধাচ যাকে বলে।এরপর প্রায়ই ও আমাকে একা গান শোনাতো। একদিন সে সাহস নিয়ে বলেছিলো যদিও তোতলাচ্ছিলো। (হাসলেন মিস নিশি)

-যাবেন? কাশবন? ফ্লাস্কে চা আছে আমার। চারপাশে শুভ্রতা আর আমার গান?
না করতে পারেনি। কোন এক অজানা টান আমাকে ধাবিত করেছিলো সেদিন। এ কয়দিনে আমার বোঝা হয়ে গিয়েছিল, আর পাঁচটা ছেলের চেয়ে ও আমার স্বত্তায় একটু বেশিই চেপে বসেছে। একটা পুরনো ছাউনির নিচে গিয়ে বসেছিলাম সেদিন। চারদিক শুধু সাদা আর সাদা। ওর গানের অর্থ সেদিন সাধারণ পথিক না বুঝলেও আমার বোধগম্য ছিল তা।

অলিখিত হলেও অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ভালবাসাটা প্রকাশ হয়েছিল সেদিন৷ কেউই না করতে পারিনি। ছাউনির নিচে বসে থাকা দুটি চড়ুইপাখি ব্যতিরেকে জগতের আর কেউ কোথাও তা প্রত্যক্ষ করেনি। এরপরে আরকি! দেখতে দেখতে বছর দুয়েক বেশ কেটে যায়। প্রেম গভীর থেকে আরো গভীরতর হয়। ওর দিক থেকে বলতে পারবো না। তবে আমার দিক থেকে অবশ্যই। ও বাদে কোন ছেলের প্রতি এ দুবছরে এটুকু আকৃষ্ট হয়েছিলাম কিনা, বোধ হয়না। 
ক্লাসমেটরা মাঝেসাজে টিটকিরি করতো। বিশেষ করে চারুকলার রাজিব। 
-শেষ পর্যন্ত জুনিয়র? 
কিছু বলতাম না। হেসে চলে আসতাম।ও প্রথম বর্ষে থাকতেই প্রেম নিবেদন করেছিলো। কোন বাচবিচার না করেই প্রত্যাখান করেছিলাম।

সম্পর্কটা ভালো চললেও সারাক্ষণ অজানা আশঙ্কা মাথায় ঘোরপাক করতো।
'ও আমার ছোট, অন্যকারোর জন্য আমাকে প্রত্যাখান করবে নাতো?
কোন ক্লাসমেট বা জুনিয়রের দিকেও তাকানো বারণ ছিলো ওর জন্য। ও নিজেও লক্ষী ছেলের মতো এসব মেনে চলতো অন্তত আমার জানা মতে।দেখতে দেখতে ভার্সিটি জীবন শেষ হয় আমার। বাসা থেকে বিয়ের চাপ দিতে শুরু করে। এদিকে সাফাতের আরও পুরো একবছর বাকী শুধু গ্র্যাজুয়েশনেই। মনে অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধতে থাকে এক হতে পারবো তো?

এদিকে বাড়িতে আমি এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছিলাম, "আগে ক্যারিয়ার গড়বো"।
কিন্তু কে শুনে কার কথা? ছেলেপক্ষ দেখতে আসে।  বাবার বন্ধুর ছেলে। ছেলে সরকারী মেডিকেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক। বংশমর্যাদা, বাড়িঘরের অবস্থা কোন দিক থেকেই রিজেকশন সম্ভব নয়। তারা সব ঠিক করেই এসেছিলেন শুধু আংটি পড়ানোর পালা। সেদিন গরম চায়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছিলাম। বাড়ির সবাই বিষয়ই স্বাভাবিকভাবে জানলেও, বাড়ির পোষা বিড়াল আর আমি জানতাম, ভালোবাসা বাঁধা পছন্দ করেনা।

অনেক কষ্টে বাসায় সাফাতের কথা বল্লাম। মা খানিকটা সায় দিলেও বাবা আর ভাই তাদের কথায় অনড়।
একে তো বয়সে ছোট, তার উপর বেকার। কোন সভ্য মানুষদের সমাজ এ সম্পর্ক মেনে নিতো না, আজও নেবে না। 
অনেকসময় "লোকে কী বলবে?" আর "বংশের মর্যাদা" এই দুটো বাক্যাংশই নিজের ইচ্ছা, জীবন আর প্রতিশ্রুতির চেয়ে অনেক বড় হয়ে দাড়ায়। যার পরিণামে অনেককেই নিজের সুখ-আহ্লাদই বিসর্জন দিতে হয়।  আমি হয়তো তাদের মধ্যে ছিলাম না।
এদিকে বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ের দিন ফিক্সড হয়ে যায়। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সাফাতের প্রতি আমার ভালোবাসাটা এতটাই গভীর ছিল, আমি বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও আমি ছেলের নাম পর্যন্ত জানতাম না।

ঠিক করলাম এ বাড়িতে আর নয়। বেরিয়ে পড়লাম এক কাপড়ে। ব্যাগে এ পর্যন্ত টিউশনি থেকে জমানো ত্রিশ হাজার টাকা আর বিভিন্ন জায়গায় এপ্লাই করা চাকুরির কাগজপত্র।সাফাতকে না জানিয়ে সোজা ওর হোস্টেলে গিয়ে উঠলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় ওর রুমমেটরা পর্যন্ত বিস্মিত। সেই দিনটা এক সদ্য বিবাহিত বান্ধবীর বাসায় কাটালাম। পরদিন বান্ধবী একটা বাসা অ্যারেঞ্জ করে দেয়। ভাড়া ৫ হাজার। বান্ধবীর স্বামী আর বান্ধবী নিজেরা দাড়িয়ে থেকে বিয়ে দেয় আমাদের। এদিকে বাড়ি থেকে খোঁজখবরের কোন চেষ্টাও হচ্ছে না। বাবা এক কথার মানুষ, এমনটা যে হওয়ার ছিলো তা অনুমানই করেছিলাম। কষ্ট হচ্ছিল মার জন্য। জানিনা বাবা আর ভায়ের মানসিক নির্যাতনে ওনি এখন কেমন আছেন।

বিয়ের রাতে সাফাতকে শুধু বলেছিলাম,
-বাসা ভাড়াটা আমি ম্যানেজ করে নিবো। তুমি পড়ালেখাটা চালিয়ে নিতে পারবে তো?
সাফাত সেদিন 'হ্যাঁ' সূচক মাথা নেড়েছিলো। বিয়ের ১২ দিন হয়ে গেলেও সাফাত নিজের বাড়িতে তখনও কিছুই জানায়নি। আমি মেয়ে হয়ে যেখানে বলতে পেরেছি, সেখানে ওর ব্যপারাটা আসলেও কেমন লাগছিলো। তবুও কিছু বলিনি। ভাবছিলাম ওর হয়তো সময় দরকার। 
গণপূর্ত হতে যোগাযোগ করা হলো। বুঝলাম এবার চাকরিটা হচ্ছে। বেতন কুঁড়ি হাজার। বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, আজ হয়তো অ্যাপোয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে পেলে  বাবা ফের তিন গ্রাম মিষ্টি বিলাতেন।
(গগণবিদীর্ণ দীর্ঘশ্বাস)

বেশ কিছুদিন পর সাফাত বাসা বদল করতে বলে। কোন কারণ জানতে চাইনি, বাসা বদলালাম। ওর টিউশনি আর আমার অফিস; ওকে আগের মতো সময় দিতে না পারলও ভালোই চলছিলো। হঠাৎ একদিন অনেক রাতে সাফাতের একটা ফোন কল এলো। বারান্ধায় গেলো,  জিজ্ঞেস করিনি কে। ঘন্টাখানেক বাদ সাফাত বেরিয়ে যায়। সে রাতে আর ঘুম হলো না। আজকের মতো মোবাইল ফোন এভেইলেবল ছিলনা যে, ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবো। ড্রিম লাইটের আলোতে হাজারো প্রশ্ন মনে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিলো। ভোরের আলো ফুটতেই সোফায় একটা ভাজ করা চিঠি আবিষ্কার করলাম।

"যা হয়েছে.... আমি দুঃখিত। পারলে ক্ষমা করে দিও। খোঁজার চেষ্টা করো না।"

মূর্হুতেই গোছানো জীবনটা যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়লো উপলব্ধ হলো।
অবিশ্বাসের কালো ছায়া আমার চারদিকে ঘিরে ধরলো। এটা কী আদৌ বাস্তব? হয়তো স্বপ্ন দেখছি, ঘুম ভাঙলে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
দুপুর গড়িয়ে রাত হলো। ঘটনার আকস্মিকতায় ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারিনি। 
আশেপাশের ফ্ল্যাটের কাউকে চিনি না। কখনও প্রয়োজন পরেনি যে!

সারাটাদিন না খেয়ে থেকে যখন ঘুমোতে গেলাম আবিষ্কার করলাম ডেক্সের ওপরে সাফাতের রেখে যাওয়া শেষ এবং একমাত্র স্মৃতি ওর রেখে যাওয়া ভার্সিটির 'আইডেন্টিটি  কার্ড'। সারাটা রাত জিনিসটাকে বুকে আগলে রেখেছিলাম।
_এইতো আমি তারে পাইয়াছি! পাইনি?
ভাবতে পারো, ভালোবাসাটা কোন পর্যায়ে পৌছালে কেউ একটা সামান্য আইডেন্টিটি কার্ডে কারো অস্বিস্ত অনুভবের চেষ্টা করে?
(হল পুরো নিস্তব, মনে হচ্ছে কয়েকটা মৃত গাছের সম্মুখে বক্তব্য রাখছেন নিশি)

পরদিন বিকেলে ঘুম ভাঙলো। হয়তো সংজ্ঞাহীন ছিলাম বেশ কয়েক ঘণ্টা। চোখ খোলার পর কয়েক'শ যদি চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে।
যদি সেদিন বাবার পছন্দ করা ছেলেটাকে বিয়ে করতাম, যদি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে যেতাম,  যদি সাফাতের সাথে দেখাই না হতো, যদি যদি যদি....  হাজারো 'যদি'র বেড়াজালে নিজেকে আবদ্ধ মনে হচ্ছিল। 

বাস্তবের কষাঘাতে নাকি নিছকই প্রতিশোধের ক্রোধানলে অন্ধ হয়ে এমনটা করলো সাফাত? ওর বাড়িতে কী মেনে নেয়নি? 
আড়াই মিনিটের অপমানের মূল্য সারা জীবনের বিনিময় দিতে হয় কেউ কখনও  ভাবতে পেরেছে? পাথরের কঠোরতার ভেতরেও যে একটা নরম হৃদয় থাকে তা সকলে অনুভব করতে পারে না। সাফাত হয়তো পেরেছে। আর তা হয়তো অত্যন্ত নিকৃষ্টরূপে ব্যবহারও করেছে?
হয়তো?

জীবন তার পরও থেমে থাকেনি। ইউ অল হেভ টু মুভ অন। কজ মুভিং অন ইজ লাইফ!
সেইদিনের সেই নিশি আজ তোমাদের 'মিস নিশি মনসুর'। যার কপালে স্বামীসুখ অথবা পরিবারের আশ্রয় কোনটিই জুটে নি। যে বাবা মেয়ের সাফল্যে তিন গ্রাম মিষ্টি বিলাতে পারে সেও সেদিন মেয়ের দুঃসময়ে মুখদর্শন করতে চাননি। তারপর থেকে এই আছি বেশ। নিশি বলে সহ্য করে গেছে। অন্যকেউ হয়তো  আগেই আত্মবির্সজন দিতো।

-এতটা ভালোবাসা পেয়েও কাউকে প্রত্যাখ্যান করা যায়? (মাঈসা)
-'পুরনো হলে ভালোবাসাটাও ফিকে হয়ে যায়'
-তবে সাদ? ও কে?
-ওকে আমি দত্তক নিয়েছিলাম। ঐযে বল্লাম, সৃষ্টিকর্তা একদিকে খুঁত রাখলে আরেকদিকে পুষিয়ে দেয়। জীবনটা কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হয়। সাফাত আমাকে সে উপহার টুকুও দেয়নি। কাকে বুকে জড়িয়ে বাঁচতাম?

সাদ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার তথাকথিত জননীর দিকে। 
পনের মিনিটের দীর্ঘ বক্তব্য শেষ হয়।  জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তার দ্বারা কি বর্ণিত হলো তা নিজেও জানেন না। কথাগুলো বলতে বলতে গলা জড়িয়ে এসেছিল মিস নিশি মনসুরের। চোখের চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন। হাতগুলো থরথর করে কাঁপছে।  জীবনের চরম বাস্তবতার এক মূর্ত প্রতীক মনে হচ্ছে এখন তাকে। উপলব্ধ হচ্ছে জীবনান্দের চরণের স্বার্থকতা। ঐযে বলেছিলেন,

'প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়! '

অসম প্রেম ও একটি চিঠি
সিরিজ: ভালোবাসার কাহন 
লেখক: এস.এ. সাগর।

Comments

Popular posts from this blog

জেনে নিন ইমুজি ও এর ব্যবহার!! -_-