রুবেকা (রোমাঞ্চ গল্প)


জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে আমাকে। সারারাত থানায় ছিলাম। সকালে অফিসার কয়েকটা প্রশ্ন করে আবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে বলে ছেড়ে দিলেন।

ওহ! আমার স্ত্রী দুঃখিত প্রয়াত স্ত্রীর নাম "রুবি" বড় করলে "রুবেকা আহসান"। গত রাতে ড্রয়িং রুমের সিলিং ফ্যানে ঝুলানো ওর লাশ পাওয়া গেছে। বাড়িতে আমি, কাজের মেয়ে অন্তরা আর আমার স্ত্রী ছাড়া কেউ ছিলো না। তাই প্রাথমিক সন্দেহটা আমার উপরেই পড়েছে। পুলিশ ধরে নিয়েছে আত্মহত্যা।
কিন্তু, রুবি আত্মহত্যা করবে কেন? ভালোই তো চলছিল আমাদের সংসার। গত মাসে আমার প্রমোশন হলো, বেতন বেড়ে ৭৫০০০। ছেলে এস.এস.সি দিয়ে বিদেশে লেখাপড়া করছে, ২০০০ স্কয়ার ফিটের নতুন ফ্ল্যাট কিনলাম, ওর সাথে গত ৩ মাসেও কোন মনমালিন্যের কথাও তো মনে পড়ছে না। তবে?
চাকরির সুবাধে মাঝে মাঝে বাইরে থাকতে হয়েছে ওকে ছাড়া। এ নিয়ে ওর কোন অভিযোগও ছিলনা কখনো। এসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ির একেবারে কাছে চলে এসেছি।

এলাকায় ঢোকার পরেই বুঝতে পেরেছিলাম, সবাই আমার দিকে কেমন দৃষ্টিতে দেখছে। এদেশের মানুষগুলো অপরাধ প্রমাণের আগেই কাউকে কি সুন্দর অপরাধী বানিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে এলাকায় রটে গেছে অন্তরার সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক ছিলো। রুবি এ সম্পর্কে জেনে গেছে বলেই আমি আর অন্তরা মিলে ওকে সরিয়ে দিয়েছি। পাশের ফ্ল্যটের লোকগুলোও ওদের দৃষ্টি দিয়ে আমাকে গিলে খাচ্ছে। অনেক পরিচিত জনতো বলেই ফেলেছে, "তুই এমনটা করতে পারলি?"
বাসায় এসে একেবারে ভেঙে পরলাম। ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছি। অন্তরা বার বার জিঞ্জেস করছে, "দাদাবাবু কিছু লাগবে কিনা?" আমি উত্তর দিচ্ছি না। অন্তরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আমার বাল্যবন্ধু সাত্তারকে কল দেয়। সাত্তার বিকেলে বাড়িতে এলে তারপর দরজা খুলি। ও আগেই ঘটনা জানতো কিন্তু এ অবস্থায় আমার মুখোমুখি হওয়ার সাহস পাচ্ছিল না। ও আমাকে একজন নামকরা সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে গেলো। উনি বললেন এতোটা মানুষিক সক পাওয়ার পর এতো কিছু ভাবা ঠিক না। পারলে এলাকা ছেড়ে কয়েকদিনের জন্য বাইরে ঘুরে আসার পরামর্শ দিলেন।

বাসায় ফিরে কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছি না। ইতিমধ্যে অন্তরা রুমে শরবত নিয়ে এসে বলতে লাগলো, "দাদাবাবু এখ্খান কথা কই?" আমি বল্লাম, "বল"। "দাদাবাবু আপনি বনশ্রীর তলায় থাকা বাবায় লগে যাইয়া কথা বলেন। এসব ভুতের কাইজ কারবার। আমারতো...." কথার মাঝখানেই এক ধমক দিয়ে ওকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বল্লাম। 
রাতে শুয়ে আছি। চিন্তায় চিন্তায় কখন চোখের পাতা লেগে গেছে বলতে পারবো না। হঠাৎ একটা বিশ্রী স্বপ্নে ঘুম ভাঙল। এই একই আবছা স্বপ্নটা আমি গত রাতেও দেখেছি। মনে মনে ভাবলাম, আর বিলম্ব করবো না, কালই লোকটার সাথে দেখা করবো। দেখি কি হয়!
সকালে উঠেই কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলাম। বড় গাছটা ঘেসে মোটামুটি বড় একটা কুড়েঘর। বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে ভেতরে ভীষন অন্ধকার। আমি গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লাম, "ভেতরে কেউ আছেন?"

দরজাটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। একটু আগেও মনে হয়েছিলো, খুব শক্ত করে লাগানো। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলে তাকে কোন কিছুই বলতে হলো না। লোকটা নিজে থেকেই বলতে লাগলেন, "আমি যা ভাবছি ওটাও নাকি সম্ভব। যেসব লোকের অপঘাতে মৃত্যু হয় তারা নাকি অভিশাপ প্রাপ্ত হয়। ওদের আবার বশও মানানো যায়। যদি কোন জীবিত ব্যক্তি স্বইচ্ছায় তাদের আহ্বান করে তবে তারা সারাও দেয়। তবে তারা আমরণ তাদের সাথে থেকে যাবে। তাদের ভেট দিয়ে হবে। যা চায় তা করতে হবে, যা বলবে তা শুনতে হবে। তবে এদের আহ্বান করা নাকি চরম অন্যায়। যে কোন মানুষের নাকি ক্ষতি করতে পারে। আর জীবিত প্রাণির রক্ত আর মাংস ছাড়া নাকি এ সাধনা হয়না।"

লোকটার কথা শুনে আমার মাথা ঘুরছে। বাসায় এলাম। ফ্রেশ হওয়ার কথা মনে এলো না। খাটে বসলাম, হিসাব মিলাতে আরম্ভ করলাম। গত ৬ মাসে আমাদের সংসারে যা উন্নতি হয়েছে গত ১৬ বছরেও তা হয়নি । ৬ মাসের মধ্যে সামান্য অফিসার থেকে ব্রাঞ্চের এসিস্টেন্ট ম্যানেজার। ছেলের হটাৎ স্কলারশিপে বিদেশ যাওয়া, বউয়ের গহনা বিক্রি করে ফ্ল্যাট কেনার বিষয় কেমন ঘুরপাক খাচ্ছে। তখন নতুন ফ্ল্যাটের কথা শুনে উত্তেজনায় বেশি কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি। ও বিয়ের সময় যে গহনা নিয়ে এসেছিলো বিক্রি করলে সর্বোচ্চ দু'লাখ হবে আর আমিও বিয়ের পর ওকে তেমন গহনা বানিয়ে দেইনি। তাহলে?

হটাৎ খাটের নিচে রাখা ওর টাংকে ওর আর আমার বিয়ের ছবিগুলোর কথা মনে পড়লো।বিয়ের পর ওর সাথে কথা হয়নি, এটাই প্রথম বিকেল। অনেক অনুভব করছি মানুষটাকে। যৌবনে অনেক জায়গায় ঘুরতে যাইতে চাইতো আমায় নিয়ে। সময় হয়নি!
খাটের নিচ হতে টাংকটা বের করলাম। অনেকদিন আগে রাখার পরও ওপরটা বেশ চকচকে দেখে অবাক হলাম। তালা খুললাম, টাংক হতে যা বের হলো সেদিকে বিস্ফোরিত নেত্রে ঘন্টাখানেক চেয়েই ছিলাম।

অনেকগুলো তন্ত্র মন্ত্রের বই পেলাম। তবে আমার ধারণাই কী ঠিক হলো। তবে এসব ওকে কে দিলো জানা নেই, ও বেঁচে থাকলে হয়তো বলতে পারতো বইগুলো হাতে নিয়ে উল্টাতে শুরু করলাম। অন্তরা অবশ্য আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছে,"খালাম্মা বাজার থেকে মুরগি আনে কিন্তু মুরগি রান্না করেন না, ফ্রিজেও রাখেন না।" আমি বিষয়টাকে তখন ততটা আমলে নেইনি। আসলে ভুলটা আমারই হয়েছে, ব্যাপারটাকে আরেকটু ভালোভাবে হেন্ডেল করা দরকার ছিলো। ও আসলে মুরগিগুলোকে পুড়িয়ে ফেলতো, যার লোমগুলোর কিছু অংশ মাঝে মাঝে বিভিন্ন রুমে দেখতে পেতাম।

যা বুঝতে পারলাম, রুবিকে আত্মাটাকে খুশি করার জন্য আগে প্রতি পূর্ণিমায় একটি করে পশু বলি দিতে হতো, এ পূর্ণিমায় ২৮ তম পূর্ণিমা পূরণ হবে। আর নিয়মানুসারে এই পূর্ণিমায় কোন প্রিয় মানুষকে নরবলি দিতে হতো।রুবেকা আমাকে আর আমার ছেলেকে অসম্ভব ভালোবাসতো। যা করেছে আমাদের কথা ভেবেই। যেহেতু আর কোন উপায় ছিলনা, তাই রুবেকা আত্মবিসর্জন দিয়ে এই অভিশাপের পরিসমাপ্তি ঘটালো। পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না।

কিন্তু আমি তো এসব চায়নি। ডাল-ভাত যা জুটতো সুখেই তো ছিলাম ৬ মাসে ২ বার প্রমোশন, নতুন বাড়ি, প্রাইভেট কার, ছেলের বিদেশ যাওয়া সবই কেমন যেন অসহ্য লাগছে এখন। মনে হচ্ছে এসব থেকে রেহাই মিললে বাঁচি।
রুবেকা এখন নেই। ওর সাথে সাথে অভিশাপগুলোরও পৃথিবী থেকে মুক্তি মিলেছে। এ অভিশপ্ত বাড়িতে আর এক মূহূর্তও নয়। বাড়িটা ছেড়ে দিলাম, ছেলে 'তরুণ' কে ফোন দিয়ে দেশে আসতে বল্লাম। এসব অভিশাপপ্রাপ্ত কোন কিছুই আমার চাইনা। মনে এখনও শংকা রয়ে গেছে। স্ত্রীকে হারিয়েছি, একমাত্র ছেলেকে হারাতে চাইনা।

ঘটনার কুলকিনারা না করতে পেরে পুলিশ আরেকবার আমাকে আর অন্তরাকে জিঞ্জাসাবাদের জন্য ডাকলেন। তবে তেমন কিছুই প্রমাণ করতে পারলেন না। তারা আর পাঁচটা সাধারণ আত্মহত্যার মতোই এটাকেও রিপোর্ট করলেন। ডেস্কে রাখা ফাইলগুলোর অনেক নিষ্পত্তিহীন ঘটনার মতো রুবির কাগজগুলোও আরো কয়েকশ কাগজের নিচে পড়ে রইলো। কেউ জানলো না রুবেকার মৃত্যুর অবকাশ। 
কেইস ক্লোডস!

Comments

Popular posts from this blog

জেনে নিন ইমুজি ও এর ব্যবহার!! -_-